বিপুল রায়
সুনসান ডারি ঘরটাত চুপচাপ বসি হুকা টানে আর বুল্লুস বুল্লুস ধোমা ছাড়ে জগবন্ধু। চোখুর কোনাত জল জমে, আপনে শুকি যায়। পাড়ার গাবুর চেংরাগিলারও নাগাল পাওয়া যায় না আজকাল! সগায় আপন আপন কাজে ব্যস্ত। চয়ন নাই বুলি কাহ কাহ তো এমনিতেই আইসে না। যায় ডারি ঘরটাত রস যোগাবে, তায়ে যুদি না থাকে-- কার মন বসিবে ওটে! তাছাড়া বুড়ার (জগবন্ধু) ওই একে ঘ্যানঘ্যান-প্যানপ্যান শুনির ইচ্ছা কাহরে নাই!
যেই বছর নাতি চয়ন চাকরীত যোগদান করিল, আনন্দের সীমা ছিলো না জগবন্ধুর। মনানন্দে হাজার লোকোক মিষ্টিমুখ করাইসে। নিজে সুগারের রুগী হয়াও মিষ্টির লোভ সামলির পায় নাই।
চয়ন খুব সখিন্দার চেংড়া। মনের ভিতিরা রসে পরিপূর্ণ। ঠাকুরদার সাথে ছোটো থাকি বেরাইতে বেরাইতে হয়তো এমন রসিক আর সখিন্দার হইসে। দোতারা, হারমোনিয়াম, বাঁশি, খোল, ঝাইল সব-- বাজের পারে। গানের সুরও তুলে অসাধারণ। সাঞ্ঝেরক্ষণ প্রায় প্রতিদিন ডারিঘরটাত চলে আড্ডা।... তারপর তো হুট করি চাকরীখানে হয়া গেইল।
সেইবার কালবৈশাখী ঝড়োত ডারি ঘরের একখান চালা উড়ি যায়া বড়ো ডোবাটাত পড়িল! আর একখান চালার উপর আমের গছের একটা ঠাইল ভাঙি পড়াতে ঘরটার কুনো চিহ্নয় থাকিল না!... জগবন্ধু মাথাত হাত দিয়া জুলজুল করি চায়া থাকে ভাঙা ডারি ঘরটার পাখে। মনটা ডুকুরি ডুকুরি কান্দি উঠে উয়ার। এই ঘরটা যে নয়া করি বানে দিবার মানষি নাই। বয়সের ভাড়ে নিজের দেহাটাও অচল। হরিশঙ্কর অর্থাৎ চয়নের বাপ এই ঘরটার পাখে ত্যামন একটা ধ্যান দ্যায় না। উয়ায় বানেও দিবে না-- কয়া দিসে! বেটারটে সাহাইয্য চায়া লাভের লাভ কিছুই হইল না। বেকার খালি মুখের খরচা!
চয়নোক চিঠি লেখিল জগবন্ধু। কিছু টাকার আব্দার করিল। হরিশঙ্কর তো টাকা দিবে না-- কয়ায় দিসে। সংসারের অবস্থা ভাল না হয়। কালবৈশাখী ঝড়তে খালি বুড়ার ডারি ঘরটায় ভাঙে নাই-- আন্দন ঘরটা গোটায় ভাঙি পড়িসে! সাথে থাকির ঘরের কয়খান টিনও মটকা সহ কুত্তি বা উড়ি গেইসে -- তার হদিস পাওয়া যায় নাই! ফির উমারে বড়ো ঘোড়ানিমের গছটা উকুরি পড়িসে বছির মিঞার থাকির ঘরোত! উয়াও ক্ষতিপুরন চাইসে। পবন দেবের সাথে হাত মিলি তিস্তাবুড়ি ‘প্রলয়’ ঘটে দিয়া গেইল এক আতিতে! এই অবস্থায় ডারি ঘরটার চাইতে বেশী জরুরি-- আন্দন ঘর আর থাকির টার মেরামত করা, সাথে বেচারা বছির মিঞাকও ক্ষতিপুরোন দেওয়া। তার বাদেও তো মেল্লা টাকার দরকার।
চাকরী করিলে টাকার অভাব থাকে না-- অনেকেই মনে করে। হরিশঙ্করও সেইটায় মনে করে। বেটা চাকরী করে; অভাব কিসের আর। যেলায় চায় সেলায় টাকা পায়। একবারও কি ভাবে চয়নের কথা-- কি পরিস্থিতিত আছে, ক্যাংকরি আছে! ভাবে না! উয়াক খালি টাকা নাগে! মাস গেইলেই চয়ন হিসাবের টাকাকেনা থুইয়া বাকি গোটায়কেনা বাড়িত পাঠায়। টাকা ফুরাইলে সেই কথা ফম হারায় হরিশঙ্কর! আগ-পাছ কিছু না ভাবিয়ায় টাকার আব্দার করে চয়নেরটে! বাড়ির অসুবিধার কথা শুনি ধার-দেনা য্যাংকরি হউক-- টাকা পাঠায় চয়নও! ধার করা ছাড়া তো উপায় থাকে না সেলা! বেতনের টাকা তো পরের মাসের শুরুতেই পাঠায়, হাত-খরচকেনা থুইয়া। মাসের শ্যাসোত কি আর হাতোত টাকা থাকে! বাড়ি থাকি চাইলে তো আর না’ও করির পায় না। কাজেই হাত পাতির নাগে বন্ধু-বান্ধবেরটে...
সপ্তাখানেক বিতি গেইল। চয়নের কুনো পাল্টা জবাব আসিল না, টাকাও পাঠাইল না! জগবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে হাপোনিক্কাশ ছাড়ি!... আসলে চিঠি তো পৌঁছায়ে নাই চয়নের হাতোত! পোষ্টমাস্টারোক কয়া-বুলি হরিশঙ্কর পোষ্ট বক্সের চিঠি নিকিলি নিয়া, নিজে টাকার আব্দার জানে চিঠি লেখিসে। টাকাও পাঠাইসে চয়ন।
বিতি গেইল দিনগিলা। বাড়ি-ঘর আরও টনটনা হইল। পড়ি থাকিল জগবন্ধুর ডারি ঘরটা!
দুর্গাপূজার আগে আগে চয়ন বাড়ি আসিল বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়া। প্রথম দিনেই ঠাকুরদার ঘ্যানঘ্যান-প্যানপ্যান-- আব্দারে সার! সেদিনেই হাউলি নাগে ডারি ঘরটা গড়ে দিল চয়ন। সাঞ্ঝেরক্ষণ বসিল গানের আসর। চেংড়াটার হাপসি বুলি কিছু নাই মনে হয়! সেই কুন বা মুলুক থাকি ট্রেনোত নিন বন্ধ করি বাড়ি পৌঁছাইল-- তারপরেও চোখুত নিন নাই! সখ থাকিলে কি না হয়...!
পরের দিনে সগায় ঘিরি ধরিল চয়নোক। শুনির চায় উয়ার চাকরী জীবনের গল্প। শুনাইয়া মানষিরও অভাব নাই। চয়নও গল্প শুনির জানে ভালো। রসকষে গল্প শুনায় সগাকে-- ক্যামন করি বরফের দ্যাশোত না খায়া না দায়া বন্দুক হাতে দাঁড়ে থাকে! ক্যামন করি শত্রুপক্ষের ঘাঁটি উড়ায় বন্দুকের গুলিত! সগায় মনযোগ সহকারে শুনে। বীরত্বের কাহিনী শুনি সগারে গাও উদুরি উঠে, লোম খাড়া হয়। খালি ব্যারব্যার করি কান্দে উয়ার মাও!... শহীদ ক্ষুদিরাম বসু, ভগৎ সিং-এর বীরত্বের কথা কয়া চয়ন সান্ত্বনা দ্যায় উয়ার মাক।
চয়নের আগত জগবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করির পায় না। উয়ায় সমায় দিলে তো সেই সুযোগটা পাবে বুড়া। ডারি ঘরটাত নাতির সাথে কোনেক বসির বাদে হাবিলাশ করে! নাতিক নিয়া কত কিচিম নাইফাউকশালি ভাবনা জবন্ধুর! পরিবর্তন যে মানষির ধর্ম-- বুঝে না বুড়া। চয়ন এলা একজন সৈনিক, একজন বীর যোদ্ধা কায় বুঝাবে বুড়াক! বাড়ির দুঃখ-কষ্ট শুনি নিজেকে আর দুঃখী করির চায় না উয়াও। বাপ-মাও, ভাই-বইনি, ঠাকুরদা-ঠাকুমা সগাকে ছাড়ি কত কষ্ট সইহ্য করি যে বায়রাত যায়া থাকে-- এই কথাগিলা উয়ায় কাক শুনাবে! নিজের কষ্টের কথা কয়া কাহকে কষ্ট দিবার চায় না।... তাছাড়া বাপ হয়া হরিশঙ্কর-- বেটাক একটাবারও পুছ করে নাই যে, ক্যামন আছে উয়ায়! তায়-- সাত-পাঁচ ভাবি, দুঃখ ভুলি মনটাক সবসমায় ফুর্তিতে রাখির চায় চয়ন। নিজের সাথে সাথে আনন্দ দিবার চায় সগাকে।
বাড়ির লোকোক ঠিক একটা সমায় দিবার পায় না চয়ন। খায়-দায় ঠিকে, কিন্তু সারাদিন বাড়িত থাকে না। হে পাড়া-হো পাড়া, এ বন্ধুর বাড়ি, ও বন্ধুর বাড়ি ঘুরিতে দিন যায়। কতদিন বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হয় না! মনটা কাউলায় দেখির বাদে। সখ করিও কাহ একখান চিঠি ল্যাখে না কুনোদিন! সগায় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে এলা। যেই অনির্বান একটা সমায় চয়নোক ছাড়া অচল ছিলো, সেই অনির্বানে বিয়াও করি আজকাল আর সমায় দিবার পায় না! ছোটোবেলার খেলার সাথী নরেশ আর রতন চাকরী জটের না পায়া, নাকি কেরালা খাটে! কষ্ট হয় চয়নের! কয়েক বছরের মাথায় কত পরিবর্তন...!
একদিন হঠাৎ চয়নের সাথে মৌসুমির দেখা মোড়ের মাথাত। শাঁখা-সেন্দুর নাই দেখি চয়ন টোকটোকি খাইল! “ইয়ার তো বিয়া হইসে সেই বছর কয়েক আগতে। তাহলে কি...!” এই মৌসুমিয়ে উয়ার বুকের ভিতিরা একটা সমায় দাবানল নাগাইসে! অনেক স্বপ্ন দ্যাখেয়া শ্যাষম্যাষ নিজের পথ নিজে বেছি নিল, আর চয়ন-- আধাপাগলার মতন হয়া বেড়াইল প্রায় মাস দুইয়ের মতন! সেই সমায় চিন্তায় চিন্তায় শারীলটা একেবারেই ভাঙি গেইসে উয়ার!
বছর পাঁচের মতন হইল-- মৌসুমির সাথে কথা হয় না। স্মৃতিগিলাও চাপা পড়ি গেইসে। বিশেষ কারণ ছাড়া উয়ার কথা আজকাল আর ফমও পড়ে না চয়নের।
মৌসুমিয়ে আগে আসি কইল, “ক্যামন আছিস?”
চয়নের বুকের ভিতিরাখান কাঁপি উঠিল। একজন বীর যোদ্ধা হইলেও মৌসুমিক কেনে যুনি খুব ভয় করেছে উয়ায়! খুব সংক্ষেপে, চটপট উত্তর দিল, “ভালো। তুই?”
“চলেছে...”
“আচ্ছা।”... কবার মতন অনেক কিছু থাকিলেও, এই মুহুর্ত্বে কবার মতন আর কিছুই নাই। চয়ন উল্টাপাখে মুখ ঘুরি, বাড়ির ঘাটা ধরে।
মৌসুমি কয়ায় ফেলায়, “যাবুকে! কোনেক সমায় কি দিবার পাবু না? মানেছোং, সেদিন মুই বিশাল বড়ো ভুল করিসুং! কিন্তু তুই... তুইও তো আর একটাবার মোর খবর করিস নাই!”
“ছাড় না পুরানা কথা! যা হবার হয়া গেইসে!”... চয়ন যুনি কুনোমতেই আর কথা বাড়ের চায় না মৌসুমির সাথে।
“কিছু হয় নাই চয়ন। চাইলে হামরা এলাও...”
“চাইলে কি হাঁ! চাইলে কি! প্লিজ...” চয়ন আর কিছু না শুনিয়ায় চলি যায়। মৌসুমি ভাবিরও পায় নাই চয়ন এতটা বদলি গেইসে!
খবরকেনা সেদিনে পৌঁছাইল চয়নের মাওয়ের কানোত। মৌসুমিক খুব পছন্দও করে উয়ার মাও। “কি সুন্দর-- দুর্গা ঠাকুরের মতন মুখখান! আহা রে! যেই বাড়ির বৌ হবে, রূপের আলোতে সেই বাড়ি ঝলমলাবে!”... মৌসুমিক নিয়া সবসমায় এই নাখান কত মন্তব্য করে।
পরের দিন চয়ন খাবার বসিলে, কথাটা ওঠায় উয়ার মাও। চয়ন-- বারবার এড়ে যাবার চায় কথাটা। উয়ার মাও’ও নাছোরবান্দা। বারবার একে প্রসঙ্গ...। শ্যাষম্যাষ চয়ন কয়, “কি মা, তুইও! ছাড় তো ঐলা কথা।”
“কেনে?”
“কেনে কথার মানে নাই।”
“ক কেনে?”
“উয়ার বিয়া হয়া গেইসে, মা! আর তুই...!”
“কায় কইল তোক, উয়ার বিয়া হইসে?”
“কাহ কয় নাই, মুই কছোং।”
“না বাবা, উয়ার বিয়া হয় নাই। বিয়া হওয়ার কথা ছিলো ঠিকে, কিন্তু হয় নাই।”
“কায় কইসে তোক!”
“মুই সবে জানোং বাবা।”
“মা, তুইও...! পুরানা কথা না নিকিলাইস তো!”
“খারাপের কি আছে?”
“সেদিন মোর কিছু ছিলো না বুলি উয়ায় হাত ছাড়ি দিসে! আর আজি...! না মা, উয়াক আর দরকার নাই। উয়ার রূপের বাহার উয়ারেটে থাউক। ভাঙা হাঁড়ি জোড়া নাগে না কুনোদিন!”
“ভাঙা হাঁড়িও জোড়া নাগা যায় বাবা।”
“দাগ থাকি যায় মা! ছাড় না ঐলা কথা। ধুর...” রাগ দ্যাখে, ভাতের পাতোত জল ঢালি, উঠি চলি যায় চয়ন।
দিন ঠেকি আসিল-- চয়ন আরও ডিউটিত বিড়াইল। আর কয়েকটা দিন থাকি একসাথে দুর্গাপূজা দেখির ইচ্ছা থাকিলেও উপায় নাই! সগারে মন খারাপ। বিশেষ করি জগবন্ধু বুড়া ডারি ঘরটাত চুপচাপ, আনমনে বসি থাকে। হুকা টানে আর ভাবে, “পাল্টি গেইসে চয়নটা এলা! আগের চয়ন আর নাই! শত্রুপক্ষের সাথে মোকাবিলা করি মনটায় পাষাণ হয়া গেইসে উয়ার!”
কাহরে চিন্তা-ভাবনা চিরস্থায়ী না হয়। চয়নের মনটা এলা আসলেই খুব শক্ত। সমায়ের তালে তালে হাওয়া বদল হয়। তা না হইলে মাওয়ের কথার অবাইধ্য হয়া-- ফিরি আইসা পুরানা প্রেমোক অস্বীকার করিল না হয় উয়ায়! জগবন্ধুর দুঃখও হয়তো ভাগবাটে নিল হয় ক্ষণিকের জইন্যে হইলেও...
তারিখ: 29.09.2021
4 Comments
খিউব সুন্দর নাগিল,পড়িয়া।।বিপুল রায়'ক হিদ্দের সুবাঞ্চা।
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাদের
DeleteKhub valo nagil bipul da
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete